নোনা জলের কষ্টের জীবন ‘ঝড় বইন্যায়ও গাঙ্গে যাই দুইডা ভাত খাওনের লইগ্যা মাছ না পাইলে মাইয়াডা লইয়া উপাস থাহি’

IMG_20250203_174836.jpg

Oplus_131072

আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি::; ‘মোর অইছে কষ্টের জীবন, ঝড় বইন্যা মানে না দুইডা ভাত খাওনের লইগ্যা গাঙ্গে যাই। মাছ না পাইলে মাইয়াডা লইয়া উপাস থাহি।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের জেলে পল্লীর একমাত্র নারী জেলে স্বামী পরিত্যাক্তা মীম আক্তার (২৪)। পেশায় জেলে হলেও এখনো পাননি জেলে কার্ড। তিনি স্বীকৃতি চান এই পেশার।

জানা গেছে, আমতলী উপজেলার গুশিলাশাখালীর জেলে পল্লীর বাসিন্দা মীম আক্তার। বাবা জলিল মোল্লাও ছিলেন জেলে। মীমের জন্মের ৩ মাসের মাথায় বাবা জলিল মোল্লা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর মা নামজা বেগম অন্যত্র বিয়ে করে সংসারী হন। তিন ভাই বোনের মধ্যে মীম মেঝ। বড় ভাই জাকির হোসেন সংসারের হাল ধরলেও তা বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। বর্তমানে লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশয়ী। ২০১৮ সালে মিমের বিয়ে হয় কুকুয়া ইউনিয়নের আমড়া গাছিয়া গ্রামের রুবেল হাওলাদারের সাথে। বিয়ের ১ বছরের মাথায় জন্ম হয় মেয়ে ইয়ানুরের (৫)। সন্তান জন্মের ৩ মাসের মাথায় স্বামী জাকির নিরুদ্দেশ হন। সে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। ৩মাস বয়সী সন্তান নিয়ে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না মীম। তার চেখের সামনে যেন শুধুই

অন্ধকার। বাবার পেশা অনুসরন করে জীবন বাঁচাতে তিনি নেমে পরেন জেলে পেশায়। ধার দেনা করে ৫হাজার টাকায় ছোট্ট একটি নৌকা আর সামান্য জাল কিনে মাছ ধরতে নেমে পরেন পায়রার নোনা পানিতে। ঝঞ্জা বিক্ষুদ্ধ পায়রার বুকে নারী জেলে হয়ে টিকে থাকাই ছিল মীমের জীবনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বাঁচতে হলে লড়তে হবে এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে মীম জেলে জীবন শুরু করেন। ৫টি বছর অতিক্রম করেছেন এই পেশায়। ঝড় বন্যা উপেক্ষা করে রাক্ষুসে পায়রায় মাছ ধরতে নেমে নৌকা ডুবির ঘটনাও ঘটেছে অনেকবার, তার পরও হাল ছাড়েনি মীম। মীম পায়রায় পোয়া, পাঙ্গাস, তপসীসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরেন। যখন নদীতে মাছ থাকে না তখন বালুর চরে চেউয়া (দরগি) মাছ

ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। যখন নদীতে মাছ পাওয়া যায় না তখন ৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে উপোস কাটাতে হয় মীমের। মাছ ধরার সময় দিনের বেলায় মেয়ে তার সঙ্গী হয়। রাতের বেলা মেয়েকে ঘরে একা রেখে নদীতে যান মীম। গুলিশাখালী জেলে পল্লীর জেলে দুলাল জানান, মীম আক্তার একজন অসহায় স্বামী পরিত্যাক্তা নারী নিরুপায় হয়ে মাইয়াডারে লইয়া গাঙ্গে মাছ ধইর‍্যা খায়। অর মতো দুখি মানুষ মোগো এই পাড়ায় আর নাই। জেলে পল্লীর ষাটোর্ধ গৃহবধূ দিলু বেগম বলেন, ছোড একটা মাইয়া লইয়া মীম ব্যামালা কষ্ট হরে। রাইতে গাঙ্গে মাছ ধরতে গ্যালে মাইয়াডারে একলা ঘরে রাইখ্যা যায়। খাইয়া না খাইয়া অরা দিন কাডায়।

খালে মাছ পাইলে খাইতে পারে না পাইলে মানসের ডেগোনে চাই চিন্তায় খায়। অর লইগ্যা সরকারের কিছু একটা করা উচিত। মীম আক্তার আমতলী উপজেলার এক মাত্র নারী জেলে হলেও এখনো জেলের তালিকায় তার কোন নাম নেই। তাই এই পেশায় তিনি সরকারী কোন সুযোগ সুবিধাও পান না। জেলে তালিকায় নাম লেখানোর জন্য মীম মেম্বার চেয়ারম্যান এবং মৎস্য অফিসে অনেকবার ধরনা দিয়েও তার ভাগ্যে জোটেনি জেলেকার্ড। সোমবার সকাল ১১ টা। পায়রা নদীর গুলিশাখালীর জেলে পল্লী সরেজমিন ঘুরে দেখা দেখা গেছে, কিনারে বাধা ছোট নৌকা তাতে অল্প কিছু জাল, জাল ধরার ছোট ছোট কিছু লাঠি, জাল ভাসানোর শোলা ছোট্ট নৌকায় মেয়ে ইয়ানুরকে বসিয়ে গুন গুনিয়ে গান ধরে নৌকায় খোচা দিয়ে চলছেন মাঝ নদীতে জাল ফেলতে। মাছ ধরে বিকেল ৪টার সময় ঘাটে ফিরে আসে মীমের নৌকা। সারা দিন শীতের রোদে নৌকায় কাটাতে গিয়ে মা মেয়ের মুখ শুকিয়ে যেন পোড়া কাঠের মত দেখাচ্ছে। কি মাছ পেয়েছেন জানতে

চাইলে মলিন মুখে উত্তর মীমের, স্যার তেমন কিছু পাইনি। দুইডা পোয়া চাইডা তপসী। এই মাছের দাম কত হবে উত্তর ৫০-৬০ টাকা। এ দিয়ে তোমার দিন চলবে? উত্তর আসে না। তাহলে খাবে কি? ডান থেকে বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন যা হয় তাই খাবো। যে দিন মাছ পাই না হেই দিনতো মাইয়া লইয়া না খাইয়া থাহি। কি আর করমু। পোড়া কপালে আল্লায় যা ল্যাখছে তাই অবে। কথা গুলো বলার সময় তার চোখ ভিজে নোনা জল গাল গড়িয়ে নদীর নোনা জলের সাথে মিশে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমি তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেয়ে জানতে চাইলাম। যখন ঝড় বইন্যা থাকে তখন কিভাবে মাছ ধরতে যান। ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন,দ্যাহেন স্যার প্যাডে দেওই বইন্যা মানে না মাইয়াডার মুহে দুইডা ভাত তুইল্যা দেওনের লইগ্যা গাঙ্গে যাই। বাপ গ্যাছে, মা গ্যাছে, স্বামী হেও মোরে হালাইয়া থুইয়া গ্যাছে। এহন মুই এই মাইয়াডার লইগ্যা বাইছ্যা আছি। মীম জানায়, মুই নারী জাইল্যা অইয়াও এহন পর্যন্ত কোন জাইল্যা কার্ড পাইনাই। জাইল্যা

কার্ড না পাওয়ায় মুই সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা পাই না। যহন খালে মাছ ধরা বন্ধ থাহে তহন হক্কোল জাইল্যারা চাউল পায় আবার অনেকে জাল নৌকা গরু পায় মোর কার্ড না থাহায় মুই কিছুই পাই না। জাইল্যা খাতায় মোর নাম লেহানের লইগ্যা মেম্বার চেয়ারম্যান হোগলডির আতে পায় ধরছি কেউ মোর নামডা খাতায় লেহে নাই। মুই আর কিছু চাই না আমি খালি আমার নামডা জাইল্যা খাতায় উডাইতে চাই। সরকারের কাছে মোর এইডাই দাবী।

গুলিশাখালী ইউপি চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, মীম আক্তারের নাম জেলে তালিকায় উঠানোর জন্য সকল ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
আমতলী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তন্ময় কুমার দাস বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। কি কারনে মীম আক্তারের নাম জেলে তালিকায় নেই বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমরা খুব দ্রুত নতুন করে জেলে নিবন্ধনের কাজ শুরু করবো তখন মীমের বিষয়টি দেখা হবে। আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্ম আশরাফুল আলম বলেন, মীম একজন নারী জেলে হয়েও কেন জেলে তালিকায় তার নাম নেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এবং সে আবেদন করলে তার বিষয়টি গুরত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top