মুহাম্মদ কাইসার হামিদ, কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ) : অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে প্রতিবন্ধকতার পরাজয়। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। দাঁড়াতে চায় নিজের পায়ে। জন্মের পর থেকেই দুই হাঁটু ও হাতে ভর করে চলে জুবায়ের আহমেদ। হাত দুটিও কাজ করে না ঠিকমতো। কথাবার্তা অস্পষ্ট তবু পড়াশোনার প্রতি তার অদম্য আগ্রহ শৈশব থেকে। পড়াশুনা নিয়ে বাবা মায়ের চিন্তার শেষ ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ২বছর আগে (২০২০ সালে) তার মা মারা যায়। ২০২১ সালে বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। মায়ের মৃত্যুরপর থেকে অস্বাভাবিক হয়ে উঠে জুবায়ের আহমেদ। প্রতিবন্ধী পুত্রের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন বাবা ও ভাই বোনেরা। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ঢাকার অধীনে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত বাঁধন টেকনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড বি.এম কলেজ থেকে ২০২২ সালে এসএসসি
পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অল্পের জন্য জিপিএ-৫ না পেলেও জুবায়ের আহমেদ পেয়েছিলো জিপিএ- ৪.৫৪। এ সাফল্যে তার বাবা, সৎ মা ও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করেছিলো তখন। হুইল চেয়ারে বসে কলেজে এসে ক্লাস করা জুবায়ের আহমেদ এবার ২০২৪ সালে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে সফলতার সহিত কৃতকার্য হয়েছেন। পেয়েছেন জিপিএ- ৩.৬৩। মাতৃহারা প্রতিবন্ধী জুবায়ের আহমেদের সাফল্যে আনন্দিত স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী এবং অভিভাবকরা। তবে তার এ বিজয় স্বাভাবিকদের মতো সহজ ছিলোনা। রোববার (২০অক্টোবর) বিকালে কুলিয়ারচর বাজারস্থ পপুলার মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসলে কথা হয় প্রতিবন্ধী জুবায়ের আহমেদ এর সাথে। তিনি বলেন, আমি দুই পা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি না। আমার দুটি পা সম্পূর্ণ অচল। হুইল চেয়ারে করে চলা ফেরা করতে হয়। আমি ঠিকমত কথা বলতে পারি না, কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছি। এখন খুব আনন্দ লাগছে।
আমার স্যার, সহপাঠী এবং পরিবারের সদস্যরা সবাই আমাকে খুব আদর এবং সহযোগিতা করেছেন। লেখা পড়ায় বিশেষ করে আমার পিতার পরে আমার সৎ মা, চাচা, বড় বোন, দুলাভাই ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সার্জারী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার মো. নিয়ামুল ইসলাম আংকেল আমাকে অনেক সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন। বর্তমানে আমি কিছুটা অসুস্থ। কিছুদিন আগে আমার একটি হাটুতে থাকা একটি টিউমার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অপারেশন করে অপসারণ করে দিয়েছিলেন ডাক্তার মো. নিয়ামুল ইসলাম আংকেল। তখন তিনি বিনামূল্যে ওষুধ দিয়েও সহযোগিতা করেছিলেন আমাকে। তাই এখনো এখানে এসেছি চিকিৎসা নিতে। সে কারোর ওপর যেন বোঝা হয়ে না থাকতে হয় সে জন্য সে দু’চোখ ভরা জল নিয়ে বর্তমান সরকারের নিকট সরকারী প্রতিষ্ঠানে একটি চাকুরি দাবী করেন এবং সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন। কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার পূর্ব ভাগলপুর গ্রামের হাফেজ মো. শহিদুল্লাহ ও মরহুমা জাকিয়া সুলতানা দম্পত্তির ছেলে জুবায়ের আহমেদ। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সে। তার পিতা পার্শ্ববর্তী পীরপুর চেয়ারম্যান বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম। তার পিতা বলেন, ছোট বেলা থেকেই আমার
ছেলের দুই পা অচল, কথাবার্তা অস্পষ্ট ও অস্বাভাবিক। সে সরকারি তালিকাভুক্ত একজন প্রতিবন্ধী। অনেক কষ্ট করে সে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরাও ওর প্রতি বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। অভাবের সংসারে মাতৃহারা ছেলেটা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে এতে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। তিনি তার ছেলের জন্য সকলের নিকট দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন। ডা. মো. নিয়ামুল ইসলাম বলেন, জুবায়ের আহমেদ খুবই ভালো ও মেধাবী একটি ছেলে। তাকে আমি নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। ও যতদিন বেঁচে থাকে আর আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিনই তাকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাবো। এলাকাবাসী বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বহু কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে জুবায়ের আহমেদ’কে। কিন্তু সবাইকে স্কুলে যেতে দেখে তারও পড়ালেখা করার ইচ্ছা জাগে। এরপর পার্শ্ববর্তী পীরপুর মাহবুবুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পিএসসি ও আগরপুর গোকুল চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পাস করে বাঁধন টেকনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড বি.এম কলেজে ভর্তি হয় সে।
কিন্তু দরিদ্র বাবা বই-খাতা কেনার খরচও ঠিক মতো দিতে পারতেন না। প্রতিবন্ধীর ভাতার টাকা দিয়ে কোন মতে পড়ালেখা চালিয়ে গেলেও ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারেননি বাবা। ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে হয় তাকে। এ অবস্থায় তার সাফল্যে গর্ববোধ করে এলাকাবাসী। বাঁধন টেকনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড বি.এম কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহীন আলম বলেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দৃঢ় মনোবল এবং অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে প্রতিবন্ধকতা পরাজিত হয়ে থাকে। জুবায়ের আহমেদ মেধাবী ছেলে। পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ তার। তবে ওর পরিবার খুবই দরিদ্র। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ওকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছি। জুবায়ের আহমেদ এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করা সত্যিই প্রশংসনীয় ও গর্বের বিষয়।
সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বলে প্রত্যাশা করি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে পাওয়া জুবায়ের আহমেদ এর এ সাফল্যে আনন্দিত কুলিয়ারচর উপজেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা ফাতেমাতুজ-জোহরাও। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। তাদের পাশে থেকে আমাদের সকলের উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে তাদেরকে অংশগ্রহণ করাতে হবে। তবেই দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে।