সৈয়দ জাহিদুজ্জামান দিঘলিয়া খুলনা থেকে:::::: ছোট বেলায় খনার বচনে শুনে মুখস্ত করেছিলাম ‘আট হাত অন্তর এক হাত খাই, কলা পোতগে চাষি ভাই। রুয়ে কলা না কাট পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। তিন’শ ষাট ঝাড় কলা রুয়ে, থাকগে চাষা মাচায় শুয়ে।’ সে কথা আজ সফল হতে চলেছে দিঘলিয়া উপজেলার কলা চাষিদের। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার কৃষকদের ধান মাছ চাষের পাশাপাশি কলা চাষে উৎসাহিত ও উদ্ভুদ্ধ হতে দেখে আজ মনে হচ্ছে দিঘলিয়ার কৃষকেরা খনার বচন জানে। দিঘলিয়া উপজেলার উঁচু ও ঘের পাড়ে যেসব জমিতে পানি ওঠে না ও অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদন খরচে বেশি মুনাফা অর্জিত হওয়ায় কলা চাষ এখন এ উপজেলায় সম্ভাবনাময় ও লাভজনক ফসল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কলার চারা রোপণ করে ২৪ মাসে ৩ বার ফলন পাওয়া যায়। চলতি বছরে খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার কলা চাষিদের সুদিন
বইছে বলে অনেকে মনে করছেন। মাটি ও আবহাওয়া কলা চাষের উপযুক্ত। তাই দিন দিন দিঘলিয়ায় কলার আবাদও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই এলাকায় কলা চাষের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও পরিবহণ সংশ্লিষ্টতায় জড়িত রয়েছেন শত শত মানুষ। উপজেলার কৃষি পরিবারের পুকুরের পাড়, খামারবাড়ি, মাছের ঘের, পান বরজের চারপাশ, পতিত জমিসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কলার বাগান। তাই স্থানীয় কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কলা চাষ করে লাভবান হচ্ছে। এর ফলে অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও এসেছে অনেকের। অর্থকরী ফসল হিসেবে কলা চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ সকল জমির কলা সাইজে খুব বড় ও দেখতেও আকর্ষণীয় হওয়ায় চাহিদাও বেশী। এছাড়া দেশে উৎপাদিত কলা ফরমালিনমুক্ত ও পুষ্টিমান অধিক থাকায় এর চাহিদা বেশি। এই উপজেলার মাটি দোআঁশ ও বেলে দোঁআশ হওয়ায় কৃষকরা চাষাবাদের ক্ষেত্রে ধান আবাদকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। লাভজনক ফসল হিসেবে কলা চাষের ওপর ঝুঁকে পড়ছেন। এরইমধ্যে কলাচাষ এই উপজেলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কলাচাষ করে
স্বাবলম্বী হয়েছেন উপজেলার পানিগাতী গ্রামের মোঃ মাহবুবুর রহমান, লিয়াকত আলী খান, মোঃ আশিক শেখ, মোঃ আরব আলী, মোশাররফ মোড়ল, বারাকপুরের লাখোহাটি গ্রামের ইমরাণ, মিজান শেখ, আবুল শেখ, হারুন শেখ, মোস্তাক গাজীসহ আরো অনেকে। তাদের এই সাবলম্বীর চিত্র দেখে উপজেলার অন্যান্য কৃষকেরাও এখন কলা আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সাগর কলা, আনাজি কলা, ঠোঁটে কলা ও চাঁপা কলা। এ বছর কলার বাম্পার ফলন হওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। অল্প খরচে অধিক ফলন এবং বেশি লাভবান হওয়ায় কৃষকেরাও ঝুঁকছে অমৃত সাগর কলা চাষে। উপজেলায় অমৃত সাগর, সবরি, ঠোঁটে, চাঁপা, কবরী, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে। তবে সবরি, কাবলী, সাগর ও দুধ সবরি, চাঁপা ঝকলার চাহিদা অনেক বেশি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ধান, পাট ও আখসহ প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনায় কলা চাষে শ্রম ব্যয় খুবই কম। বিক্রির ক্ষেত্রেও ঝামেলা নেই। কলার বাজার দরেও সহজে ধস নামে না। আর এর চাহিদাও দেশে প্রচুর পরিমাণ লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত বৈশাখ মাসের শুরুতে কলার চারা রোপণ করলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফল পাওয়া শুরু হয়।
প্রতি এক বিঘা জমিতে জাত ভেদে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ কলার চারা রোপণ করা হয়। এক বিঘা জমিতে কলাচাষ করতে ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘাপ্রতি কলা ৭০-৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কলার চারা বছরে তিন মৌসুমে রোপণ করা যায়। প্রথম মৌসুম মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ, দ্বিতীয় মৌসুম মধ্য মার্চ থেকে মধ্য মে এবং তৃতীয় মৌসুম মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর। একবার কলার চারা রোপণ করলে ২-৩ মৌসুম চলে যায়। কলা চাষিরা জানান, এক একর জমিতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করলে তাদের আবাদি কলা বিক্রি হয়ে থাকে এক থেকে সোয়া লাখ টাকায়। দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দিঘলিয়া উপজেলায় প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ করা হয়েছে। যার মাঝে অধিকাংশই অমৃত সাগর কলা। ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা। উপজেলার ব্রহ্মগাতী, পানিগাতী, নন্দনপ্রতাপ, লাখোহাটি, হাজীগ্রাম, মোমিনপুর, মোল্লা ডাঙ্গা, আড়ুয়া, বোয়ালিয়ারচর, কামারগাতী, আমবাড়িয়াসহ
প্রতিটি গ্রামে কলা চাষ হয়। খরচ গিয়ে প্রতি হেক্টরে ৬০ হাজার টাকা মুনাফা হওয়ার আশা করছে কৃষকরা। উপজেলার লাখোহাটি গ্রামের কলাচাষে সাবলম্বী হারুন শেখ বলেন, আমি কলাচাষে সাফল্য পেয়েছি। বিগত ১০ বছর যাবত কলা চাষ করে আসছি। চলতি মৌসুমে ৩০ হাজার টাকার জমি পোষানি নিয়ে তার নিজস্বসহ তার ৭৫ শতাংশ জমিতে কলার চাষ করেছেন। কলাচাষি মিজান শেখ জানান, আমি সবসময় সবজি চাষ করে থাকি। এরমধ্যে আগাম শিম, ফুলকপি, লাউ, টমেটো এবেং বেগুন। আমার একই গ্রামের কৃষক আবুল শেখের কলা আবাদে অল্প খরচে অধিক ফলন দেখে আমি এ বছর আমার ঘেরের চারপাড়ে আনাজি কলা, ঠোঁটে কলা, চাঁপা ও সাগর কলার চারা রোপণ করে গত এক বছরে ৮০ হাজার টাকার কলা বিক্রি করেছি। আরো লাখ টাকার মতো কলা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান তিনি। এদিকে কলা চাষিরা তাদের উৎপাদিত কলা বিক্রি
করেন স্থানীয় বাজারগুলোতে। এখানকার বাজারগুলোতে সরেজমিন দেখা যা উপজেলার কোলা বাজার, গাজীরহাট বাজার, বারাকপুর বাজার, পথের বাজার, পুলের বাজার, কামারগাতী কলা বাজারে সবরি কলা প্রতি ছড়া ছোট থেকে বড় আকারের প্রকার ভেদে ৩০০-৬০০ টাকা, সাগর কলা ২৫০-৫০০ টাকা, চাম্পা কলা ১০০-৩০০ টাকা এবং ঠোঁটে কলা ৩০০-৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. কিশোর আহমেদ জানান, এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কলাচাষের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। ভাইরাসজনিত রোগবালাই ও মৌসুমি ঝড় কলাগাছের প্রধান শত্রু। তবে এবার কলার বাম্পার ফলন হয়েছে। একই সঙ্গে দামও পেয়েছে গতবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।