সৈয়দ জাহিদুজ্জামানঃ খুলনা বিভাগে গত দুই বছর আগ থেকে পাটের দাম এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাট চাষে উৎসাহিত হয়েছেন খুলনা বিভাগের কৃষকরা। কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাটের চাষ করেছেন। বছরের শুরুতে কাঁচা পাটের মূল্যও ছিল বেশ চড়া। চাঙ্গা ছিল বাজার। মণ প্রতি ৩-৪ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে তখন। হঠাৎ এ মাসের শুরুতে সেই দামে অজ্ঞাত কারণে নামে ধস। প্রতিমণ পাটের মূল্য কমে গেছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। এদিকে, বছরের শুরুতে পাটের বাজারে হঠাৎ করে ধস নামায় কৃষক ও কাঁচা পাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাঝে একদিকে
হতাশা দেখা দিয়েছে অপরদিকে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। কাঁচা পাটের বাজারে বড় ধরনের দর পতনকে সংশ্লিষ্টরা কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির বিশেষের ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছেন। পাটচাষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের শুরুতে যখন কাঁচা পাট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার টাকার উপরে, সেখানে এভাবে হঠাৎ করে ধস নামতে পারে না। তারা এর সঠিক কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অপরদিকে রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভিন্ন কথা। তাদের দাবী প্রথম ধাপের পাটের কোয়ালিটি ও অবস্থা ভালো থাকে। বাজারে পরে যে পাট আসে সে পাটের কোয়ালিটি ডাউন হয়। আবার ভিজা পাট বাজারে আসতে শুরু করে। যে কাভণে পাট ব্যবসায়ীরা পাট কিনতে গড়িমশি করে। তবে পাট বাজারে এক শ্রেণির ষড়যন্ত্রকে উড়িয়ে দেওয়া যাবেনা। পাশাপাশি রপ্তানিকারক দেশের চাহিদা
অনুযায়ী কাঁচাপাট সরবরাহ না করা এবং দেশের কারখানাগুলোর চাহিদা মেটানোর কারণে কাঁচাপাট রপ্তানি কমে যাচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও কমছে। ফলে অনেকেই ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশনের (বিজেএ) তথ্য মতে, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের মধ্যে দেশের কাঁচাপাট রপ্তনিতে ব্যাপক পতন হয়েছে। রপ্তানি কমে যাওয়ায় ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের লোন সমন্বয় করতে না পারায় অনেকে জেলে, আবার কেউবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিজেএ’র সূত্র জানায়, দেশে মোট পাটের উৎপাদন ৯০/৯৫ লক্ষ বেল। দেশের মিলগুলোর চাহিদা ৫৫ লক্ষ বেল। আমাদের দেশ থেকে ৩০/৩৫ লক্ষ বেল রপ্তানি করতে হবে এবং এ পাট রপ্তানিকারকদের হাত ধরেই বিদেশে রপ্তানি হবে। কিন্তু এ দেশের একটা মহলের কাঁচা বজার নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের কারণে প্রতি বছর কাঁচা পাট বাজারে ধস নামে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে এ দেশের কৃষক ও ক্ষুদ্র পাট
ব্যবসায়িরা। এমনও অর্থবছর ছিল যে সময় বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৯ লাখ বেলের বেশি পাট রপ্তানি করত ব্যবসায়ীরা। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে পাট রপ্তানিতে ধস হওয়ায় আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে পাট রপ্তানি। সর্বশেষ অর্থবছরে মাত্র ১২ লাখ বেল কাঁচাপাট রপ্তানি করেছে। এদিকে বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে পাট রপ্তানি হলে সেটি কমে এসেছে মাত্র ২৫টি দেশে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এখনো বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ পাট আমদানি করছে। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) এর রিপোর্ট মোতাবেক ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৫১ জন ব্যবসায়ী ১২ লাখ ৩৫ হাজার ১০৮ বেল পাট রপ্তানি করে বলে জানানো হয়। এসব কাঁচাপাট চট্টগ্রাম, বেনাপোল, মোংলা ও বাংলা বান্দা বন্দর থেকে রপ্তানি হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ব্রাজিল, বেলজিয়াম, ভিয়েতনাম, আইভরি কোস্ট, এলসারভাদর, রাশিয়া, ফিলিপাইন, ইউকে, তিউনিশিয়া, কোরিয়ায় মোট ১৩টি দেশে পাট রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ
৫৮ হাজার ৭০৮ বেল, পাকিস্তানে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫৫ বেল ও চীনে রপ্তানি হয়েছে ৪৭হাজার ৩৪৬ বেল। বিজেএর খুলনার অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে দেশ থেকে পাট রপ্তানি হয়েছিল ২৮ লাখ ৭০ হাজার ৯৮৪ বেল। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ৩০-৩৫টি দেশ কাঁচাপাট নিতো এবং ৭০/৮০ জন রপ্তানিকারক সেইচাহিদা পূরণ করতেন। খুলনার নাম পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক কয়েকজন পাট রপ্তানিকারক এ প্রতিবেদককে জানান, সরকারের নানা পলিসির কারণে বিদেশী বাজার নষ্ট ও সময় মত চাহিদা অনুযায়ী কোয়ালিটির পাট রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতার কারণে বাজার নষ্ট হওয়ায় কাঁচাপাট রপ্তানি কমেছে। এছাড়া দেশে কাঁচাপাট উৎপাদনও কমে যাওয়ায় পাট রপ্তানি হ্রাসের প্রধান কারণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যে পাট রপ্তানি করা হয়েছে তাতে রপ্তানিকারকরা বেশি লাভ করতে পারেনি। তাছাড়া পাটের দামও ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা মণ প্রতি বেশি হওয়ায় পাট কিনতে অনীহা ছিল ব্যবসায়ীদের। তিনি আরও বলেন, দেশেই অনেক কারখানা তৈরি হয়েছে। যার ফলে উৎপাদিত কাঁচাপাটের বড় একটি অংশ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা
মেটানোর কারণেও পাট রপ্তানি কমেছে। খুলনা ও নারায়ণগঞ্জের কাঁচাপাট ব্যবসায়ীরা আশংকার মধ্যে আছে। এদিকে খুলনার অনেক মিল মালিক পাটের প্রথম বাজার থেকে চাহিদার চেয়ে বেশি পাট ক্রয় করে। কাঁচাপাটের মূল্য বাড়ার সাথে সাথে পাট রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি কখনও পাট রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে কাঁচাপাট বিক্রি করে দিয়ে পাটের ঘাটতি ও দুর্মূল্যের শ্লোগান তুলে মিল বন্ধ করে কর্মহীন বেকার শ্রমিকদের কাতারে ঠেলে দিয়ে ত্রিমুখী মুনাফা লুফে নেয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সভাপতি শেখ সৈয়দ আলীর সাথে কাঁচা পাট রপ্তানি নিয়ে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে একটা
সূত্রে জানা যায়, করোনাকালীন কাঁচাপাট ব্যবসায়িদের খুবই খারাপ অবস্থা হয়েছিল। সরকার থেকে কোন প্রণোদনাও দেওয়া হয়নি। দিনে দিনে দেশ থেকে কাঁচাপাট রপ্তানি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা হতাশায় পড়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক লোন সমন্বয় করতে পারেনি। রপ্তানি কমে যাওয়ায় আয়ও কমছে। ফলে ব্যবসায়ীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। খুলনা তথা বাংলাদেশে ধ্বংস প্রায় কাঁচা পাট বাজার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাট উৎপাদনকারী কৃষককূলকে বিনাশ করার কাজে লিপ্ত হয়েছে একটি সিন্ডকেট। যার দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে না পারলে বাংলার সেই সোনালী আঁশ বিনাশই হবে। বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী কাঁচাপাট তার ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে বাংলার বুক থেকে এটাই বিজ্ঞমহলের অভিমত।