লেখকঃঅধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান মার্কেটিং বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:::: ভূমিকা: দর্শনের শত শত সংজ্ঞা আছে । আমাদের আলোচ্য বিষয়ের প্রেক্ষিতে যে সংজ্ঞাটি যুৎসই মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে, “a theory or attitude that acts as a guiding principles for behaviour.” এক কথায় দর্শনের বিষয়বস্তু হচ্ছে- “কেন”(why?) । যত “কেন” হতে পারে তার উত্তর দেয়াই হচ্ছে দর্শনের কাজ। একসময় দর্শন
এবং ফিজিক্যাল সাইন্স সমার্থক ছিল । প্রকৃতি সম্পর্কে তেমন কিছু না জেনেই মানুষ এই পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাস শুরু করেছিল । অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ যেমনটি বলেছিলেন- “প্রকৃতি এবং প্রকৃতির নিয়ম ছিল গভীর অন্ধকারে ঢাকা; ঈশ্বর বললেন, “নিউটন সেখানে পৌঁছাও” অমনি সবকিছু হয়ে গেল আঁকা।” অনেক সময় বৈজ্ঞানিক যুক্তিও মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে না ।
মানুষ তাঁর পূর্বনির্ধারিত মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই বেশি পরিচালিত হয়; হোক সেটা কুসংস্কার । শিক্ষা ও বিজ্ঞান দ্বারা বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তন কখনো কখনো সম্ভব হলেও সংস্কার থেকে মানুষকে শতভাগ বাইরে আনা প্রায় অসম্ভব । আমাদের মত দেশে এটা আরও দূরহ । যেমনটি বলেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়- “আমি ক্লাসে এত কোরিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়।
তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইলো, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল । ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ ।” দর্শন প্রাচীনতম বিদ্যা । খ্রিষ্টপূর্ব কাল থেকেই দর্শনের চর্চা চলছে । আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতেই যে বিষয়গুলো পড়ানো হতো তারমধ্যে দর্শন অন্যতম। তবে শুরুতে
দর্শন ও মনোবিজ্ঞান একটাই বিভাগ ছিল । ১৯৭৪- ৭৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আখতার উল আলম স্যার আমাদের যুক্তিবিদ্যা পড়িয়েছিলেন । এখন দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের শাখা প্রশাখা নিয়েও একাধিক বিভাগ আছে । মনোবিজ্ঞান নিয়ে বিভ্রান্তির সূচনা হয় ইংরেজি ‘সাইকোলজি’ শব্দের বাংলা যখন মনোবিজ্ঞান করা হয় তখন থেকেই । মনোবিজ্ঞানে মন শব্দটির আধিক্য
থাকায় বেশিরভাগ মানুষই মনে করে মনোবিজ্ঞান হচ্ছে মনের বিজ্ঞান (psychology is the science of mind)। এ নিয়ে বিতর্ক- পাশ্চাত্যেই প্রথম শুরু হয়েছিল । মনের অস্তিত্বই প্রশ্ন সাপেক্ষ । মন আছে কি নেই এ নিয়েই প্রশ্ন । মন ভেঙে যাওয়া এক যুবক যেমন বলেছিল, “হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করে একটা কথাই জেনেছি, পৃথিবীতে মন বলে কিছু নেই”। যেটা আছে কি নেই, এনিয়েই সন্দেহ, এটা বিজ্ঞান হয় কি করে ?
আর মন থেকে থাকলেও, মনের কি এমআরআই বা এক্সরে করা যাবে? সিলিন্ডারে ঢুকিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে গবেষণা করা যাবে? অতএব মন বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারে না । এক পর্যায়ে বলা হলো psychology is the science of soul বা আত্মার বিজ্ঞান । সমস্যা আরো জটিল হল । শরীরের কোন অংশ আত্মা ? মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় যায় ? আত্মারও একই অবস্থা এমআরআই, এক্সরে করা যায় না । অতএব
আত্মা কোনভাবেই বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারেনা । এমন বিতর্কের মধ্যেই আধুনিক কালে এসে বলা হলো “psychology is the science of human behaviour” । এতে সবাই সম্মতি জানালো । কারণ আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায় । আচরণ নিয়ে গবেষণা করা যায় । এমনকি আচরণের পূর্বানুমানপূরণও করা যায় । অতএব আজকের দিনে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হচ্ছে, “মানুষ কেন এমন করে, যেমনটি সে করে” ।
মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করলে মানুষের আচরণের একটা মোটামুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আচরণের গভীরতম ব্যাখ্যা নিহিত থাকে দর্শনে । কারণ মানুষের আচরণ তাঁর পূর্বে তৈরি মনোভাব বা প্রিডিসপজিশন দ্বারা নির্ধারিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় । আমরা যা করি না কেন সবকিছু আমাদের মনোভাব তথা পূর্বে ধারণকৃত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নির্ধারিত হয় । এমনকি অবচেতন বা অর্ধচেতন অবস্থায় যা করি তাও আমাদের
অতীত জীবনের সাথে সম্পর্কিত কোন অভিজ্ঞতা বা এই মুহূর্তে ভুলে থাকা অতীতের কোন ঘটনার সাথে সম্পর্কিত । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমরা যে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত হই যেমন- আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, হেফাজত, খেলাফত, তাবলীগ, হরকাতুল জেহাদ ইত্যাদি ; এগুলো আমরা পছন্দ করি বলেই করি । কারণ আমরা যে সংগঠন করি বা সমর্থন করি, তাতে আমরা আমাদের দার্শনিক চিন্তার
প্রতিফলন দেখতে পাই । অতএব আমরা অনেকেই দর্শন কি জানিনা, জীবনে একটি দর্শনের বইও হাতে নিয়ে দেখেনি ; তারপরও আমরা প্রত্যেকেই এক একজন দার্শনিক এবং আমরা নিজেদের দর্শন দ্বারা পরিচালিত হই ; এর দ্বারাই তৈরি হয় আমাদের জীবনবোধ । দর্শন আমাদের জীবনে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে । ধরা যাক, আমাদের দুই বন্ধু শান্ত এবং প্রশান্ত । শান্ত অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত, সে এমবিএ
পড়ছে, মোবাইল ফোনের ব্যবসা করছে, গ্রামে মাছের খামারে মাছ চাষ করছে, অনলাইনে ভোগ্য পণ্যের দোকান খুলছে, কানাডায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি । তাঁর দম ফেলার সময় নেই অনলাইন অফলাইন দুই ভাবেই সে চরমভাবে ব্যস্ত । এর বিপরীতে আমাদের বন্ধু প্রশান্ত শুধু এমবিএ টা পড়ছে, আর বাকি সময়টুকু ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করছে । প্রথমে শান্তকে সিরিয়াস রিমান্ডে নেয়া হলো ।
নামে শান্ত হলেও তাঁর এতকিছু নিয়ে এত ব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞেস করা হলো । শান্তর সাফ জবাব, “দুনিয়াতে সময় খুব কম, যা করার তা দ্রুতই করতে হবে।” কেউ একজন নাকি তাকে বলেছে, “এই দুনিয়ায় যে যত ভালো থাকবে, সে পরকালেও তত ভালো থাকবে”। অর্থাৎ এই দুনিয়ায় যে ধনী পরকালেও সে ধনী । সেটা বিশ্বাস করেই সে এতকিছু করছে । অপরদিকে প্রশান্তকে জিজ্ঞেস করা হলো তুমি এত চুপচাপ ধীরস্থির
কেন? প্রশান্ত জবাব দিল, “ভাইরে, দুই দিনের এই দুনিয়া, দুনিয়া হচ্ছে পরীক্ষার ক্ষেত্র স্বরূপ, অনন্তকালতো হাশরের ময়দানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । তাছাড়া কিতাবে লেখা আছে, ‘এই দুনিয়ায় যার যত বেশি হবে, পরকালে তাঁর হিসাবও তত বেশি হবে’।” অতএব প্রশান্ত কমের মধ্যে আছে । লক্ষণীয় আমাদের বন্ধু শান্তের সবকিছু করার চেষ্টা এবং প্রশান্তের সীমিত জীবন যাপনের পিছনে তাঁদের নিজ নিজ জীবনবোধ কাজ
করছে । এটাই তাঁদের দর্শন । ব্যক্তি জীবনে আমরা যে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করি তার পেছনে যেমন দর্শন কাজ করে একই কথা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । প্রত্যেক ব্যবসায়ী বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান একইভাবে আচরণ করে না । তারাও ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে । বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই ক্রেতাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করে । আবার অনেকেই খুব রূঢ় এবং অনৈতিক আচরণ করে । এক্ষেত্রে তাঁদের
নিজস্ব দর্শন কাজ করে । এক্ষেত্রে ব্যক্তি (বন্ধু) ও ব্যবসায়ী সংগঠনের (লোকাল বাস কোম্পানি) আচরণের সামঞ্জস্য নিয়ে ফোক গান আছে, “বন্ধু, তুই লোকাল বাস, আদর কইরা ঘরে তুলোস ঘাড় ধইরা নামাস।” বাজারজাতকরণের ছাত্রদের আবশ্যিকভাবেই মনোবিজ্ঞান পড়ানো হয় । কিন্তু দর্শনের প্রতি তেমন জোর দেয়া হয় না । দর্শনের বইয়ে যেমন বিভিন্ন মতবাদ থাকে তেমনি বাজারজাতকরণ দর্শনও অনেকগুলো
মতবাদ নিয়ে আলোচনা করে । পরবর্তী কিস্তিগুলোতে আমরা বাজারজাতকরনের বিভিন্ন মতবাদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এগুলো পরম্পরা এবং সর্বশেষ চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা করব । (চলবে..)