খুলনায় চেক ও স্ট্যাম্প জালিয়াতি চক্রের সন্ধান

স্টাফ রিপোর্টারঃ রিজেন্ড শাহেদ কিংবা কথিত চিকিৎসক সাবরিনা। আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো প্রতারকই পার পাইনি। প্রতারক যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন, আইনের শেকলে বাধা পড়তেই হবে। খুলনায় শাহেদ খ্যাত এক প্রতারকচক্রের সন্ধান মিলেছে। যিনি অনবরত থাকছেন ধরাছোয়ার বাইরে। ব্যাংকের চেক বই কিংবা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প। হুবহু বানিয়ে ফেলেন রাতারাতি।তার বিরুদ্ধে জমির ব্যবসা, চাকরির নিয়োগ ও সরকারী চাকুরিজীবীদের বদলী করার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অহরহ। আর এসব কাজে সিকিউরিটি হিসেবে ব্যবহার করেন ব্যাংকের নকল চেক , স্ট্যাম্প ও ভুয়া বদলীর কাগজ। খুলনায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা জাল জালিয়াতি মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ( পি বি আই) কে তদন্তভার দেয় আদালত। তদন্ত শেষে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণা

করে অর্থ আত্মসাৎ এর দায়ে দুইজনকে আসামী করে তদন্ত রিপোর্ট দেয় পি বি আই। আদালত তদন্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে এ চক্রের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। এখবর শুনেই লাপাত্তা হয়ে যায় চক্রটির মূল হোতা মোঃ সাজ্জাদ হোসেন ও তার অন্যতম সহকারী অনিক পারভেজ পাভেল। চক্রটির সদস্য ৮/১০ জন হলেও মাষ্টারমাইন্ড সাজ্জাদ সর্বদাই থাকেন ধরাছোয়ার বাইরে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায় এ চক্রের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে দলিল লেখক, কম্পিউটার অপারেটর, রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বসহ অনেকে। জানা যায়, এক সময়ে বাংলাদেশ নেভীর কোস্ট গার্ডে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন। নিয়ম বহির্ভূত কাজ করায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয় তাকে। দীর্ঘ সময় জেলে থাকার পর বের হয়ে নানা কুকর্মে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার ফাঁদ থেকে রেহাই পায়নি মোঃ সরোয়ার হোসেন খান নামক ঢাকার এক ব্যবসায়ী ও তার কনিষ্ঠ ভাই মোঃ মুশফিকুর রহমান । জানা যায়,

মুশফিকুর রহমানের নিকট অভিযূক্ত সাজ্জাদ হোসেন প্রায়ই স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভের বিভিন্ন ব্যবসায়ের প্রলোভন দেখাতেন। এক পর্যায়ে তার বড়ভাইকে ব্যবসায়ের বিষয়টি অবগত করলে ১০ লাখ টাকা দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। পরবর্তীতে সাজ্জাদ গত বছরের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ নগদ ৩ লাখ ,জুনের ১৫ তারিখ নগদ ৩ লাখ এবং ৪ লাখ টাকার একটি ব্যাংক চেকসহ গ্রহন করে। নগদ মোট ৬ লাখ টাকা ও ৪ লাখ টাকার ব্যাংক চেক নিয়ে সাজ্জাদ তার মিডল্যান্ড ব্যংকের একটি চেকের পাতা দেয় (একাউন্ট নং- ০০২৩১৭৫০০০৫২৭৭)। যার পরিমান ছিল ৬ লাখ টাকা। পাশাপাশি ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্টাম্প প্রদান করে। স্ট্যাম্পের উল্লেখিত সময়সীমা অতিক্রম করায় গত বছরের ১লা অক্টোবর তার নিকট টাকা ফেরত চাইলে নানা তালবাহানা শুরু করে ও হত্যার হুমকী দেয়। একপর্যায়ে চেকটি নিয়ে ব্যাংকে গেলে তৈরীকৃত জাল চেক বলে কর্তৃপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে। সাজ্জাদের গোমর

ফাঁস হয়ে গেলে ভুক্তভোগী মুশফিক ও তার ভাই সরোয়ার আইনের স্বরণাপন্ন হয়ে খালিশপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করে। যার নং – ১৩০০/২২, তারিখ – ০২/১০/২২. পরবর্তীতে টাকাটি আদায়ে তার পরিবারের লোকদের সাথে মিমাংসার চেষ্টা করলে সেটিও ব্যার্থ হয়। টাকা চাওয়াতে হত্যাসহ নানা হুমকী দিতে থাকে সাজ্জাত গ্যাং’র সদস্যরা। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৮ অক্টোবর খালিশপুর থানায় একটি সাধারন করা হয় । যার নং – ৯৯৪, তারিখ- ১৮/১০/২২. সাধারন ডায়েরীর তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় একটি নন জি আর ও মামলা দাখিল করে খালিশপুর থানা পুলিশ। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীতে সাজ্জাদের প্রদেয় প্রত্যাখিত চেকটি দিয়ে ৪ অক্টোবর একটি নোটিশ প্রেরণ করে ভুক্তভোগী মুশফিক। ত্রিশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরে ৮ নভেম্বরে এন আই এক্টের ১৩৮ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। যার নং -৬৮৯/২২. এছাড়া ২৫

অক্টোবর সাজ্জাতের নামে চেক ও স্ট্যাম্প জাল জালিয়াতি করার অভিযোগে সোনাডাঙ্গা থানা আমলী আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। যার নং ৬২৩/২২. আদালত মামলাটির তদন্তভার পি বি আই কে প্রদান করে। ৮ নভেম্বর এজলাস চলাকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের সামনে দলবলসহ হাজির হয় সাজ্জাদ হোসেন ও তার সহযোগী অনিক পারভেজ পাভেল। মামলার বাদী মুশফিকুর জানায়, “সেসময় মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য এজলাসের সামনেই নানা চাপপ্রয়োগ করতে থাকে। একপর্যায়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে ও হত্যার হুমকী দেয়।“ এঘটনায় তিনি খুলনা সদর থানায় একটি সাধারন ডায়েরি করেন। যার নং ১৬০৯ , তারিখ ২৫/১০/২৩। এখানেই অন্ত নয়। এঘটনায় ভুক্তভোগী মুশফিকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে খালিশপুর কাষ্টমস মোড়ে সাজ্জাতসহ ২ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যাক্তি পুনরায় হুমকী দেয়। সকল ঘটনা ডায়েরীভুক্ত করার জন্য এ বিষয়টি উল্লেখ করে খালিশপুর থানায় আরেকটি সাধারন ডায়েরী করা হয়।যার নং – ৫৩৭, তারিখ

১০/১১/২০২২.তবে চেক ও স্ট্যাম্প জালিয়াতি মামলায় গভীর তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পি বি আই)। পুরো ঘটনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠান এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো: মহিদুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ব্যবসায় বিনিয়োগ করার কথা বলে সাজ্জাদ হোসেন ও অনিক পারভেজ পাভেল, বাদী মুশফিকুর রহমানের নিকট থেকে নগদ ৬ লাখ ও ৪ লাখ টাকার একটি ব্যাংক চেক গ্রহণ করেন। বিনিময়ে সাজ্জাদ নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ৬ লাখ টাকার অংক বসিয়ে একটি চেকের পাতা হুবহু জাল করে মুশফিককে দেয়।
পরবর্তীতে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাধ্যমে পিবিআই জানতে পারে চেকটি অত্যাধুনিক আল্ট্রা ভায়োলেট মেশিনের সাহায্যে তৈরী করা হয়েছে। ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারে চেকটি সম্পূর্ণ জাল। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ মহিদুল

ইসলাম জানান, বর্তমানে অনেক জটিল ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটনে সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে পিবিআই। পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমানের নির্দেশনায় এ মামলার সত্য উদ্ঘাটন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে সক্ষম হয়েছি। তবে মিডল্যান্ড ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, চেকটি অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে তৈরী করা হয়েছে। জাল চেক তৈরী করা অনেক বড় ধরনের অন্যায়। এসকল ঝামেলা এড়াতে সকলকে সচেতন হওয়া উচিত।
তবে পি বি আই’র পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে গত ৫ জুন সাজ্জাদ হোসেন ও অনিক পারভেজ পাভেলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। বর্তমানে খালিশপুর থানা পুলিশ এ চক্রকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে খালিশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মুনির-উল-আযম গিয়াস এ প্রতিবেদককে জানান,আসামীদের ধরার জন্য আমরা সর্বত্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ভুক্তভোগী জানান এ চক্রটির মুল হোতা সাজ্জাদ প্রতারনার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে মোটা অংকের সুদে অর্থলগ্নি করেন । অতিমাত্রায় সুদ প্রদান না করতে পারায় অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন বলে জানান তিনি। এছাড়া বাধন নামক একজন ঠিকাদার জানান, তিন থেকে চার বছর একটি টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৭ লাখের ও বেশী টাকা নেয় সাজ্জাদ। টাকার পরিবর্তে চেক ও স্ট্যাম্প দেয় তাকে । কাজ না হওয়ায় টাকা নিয়ে বছরের পর বছর ঘোরাতে থাকে সাজ্জাদ। বাধন জানান, “টাকার নিরাপত্তার স্বার্থে সাজ্জাদের নিকট থেকে গৃহীত চেক ও কাগজাদি সব নকল। আমি মোবাইলে কল দিলে ঠিক মত উত্তর দেয় না” । বাধনের মত অনেকই আছে, যারা সাজ্জাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। প্রশাসনের কিছু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের নাম ভাঙ্গিয়ে এই সাজ্জাদ নগরীর টপ অব দ্যা টপিক হয়ে দাড়িয়েছে। সাজ্জাদের তথ্য গোয়েন্দা সংস্থা সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট প্রেরণ
করা হলেও নির্দ্বিধায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই লাগাম অতিসত্ত্বর না টানা হলে বাধন ও মুশফিকের মত অনেকেই হবে নিঃস্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top